পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমুর জীবনী | Life story of Pandit Raghunath Murmu

Pandit Raghunath Murmu Biography 

Pandit Raghunath Murmu

পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু (Pandit Raghunath Murmu)

জীবনী

পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু ওড়িশা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জ জেলার ডাহারাডি (ডান্ডবস) গ্রামে ১৯০৫ সালের ৫ই মে বৈশাখি পূর্ণিমার বা বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে রঘুনাথ মুরমু জন্মগ্রহণ করেন। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। বাবা নন্দলাল (সিদ নামেও ডাকা হত) এবং মা সলমা (সুমি নামেও ডাকা হত)। নন্দলাল মুরমুর দুই মেয়ে—বাহা এবং সনা। রঘুনাথ হলেন তৃতীয় সন্তান। চতুর্থ পুত্রের নাম দুবরাজ। সাঁওতাল সমাজের রীতি মেনেই নন্দলাল তাঁর তৃতীয় সন্তানের নামকরণ তার ঠাকুরদার নামেই রাখেন অর্থাৎ তৃতীয় সন্তানের নাম রাখা হয় ‘চুনু’। ছোটোবেলায় চুনুর অসুখ বিসুখ লেগেই থাকত। নাজেহাল পিতা একদিন এক ওঝা ডেকে এনে ঝাড়ফুঁক করান। সেই ওঝার পরামর্শ অনুযায়ী “চুনু” নামের পরিবর্তন ঘটিয়ে রাখা হয় রঘু বা রঘুনাথ। জানা যায়, ‘রঘু’ কোন এক ওঝার নাম।

পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু এর শিক্ষা জীবন (Educational Life of Pandit Raghunath Murmu)

পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু বয়স যখন সাত বছর তখন তাকে পাশের গ্রাম গাম্ভারিয়া ইউ. পি. স্কুলে ভর্তি করা হয়। শিশু রঘুনাথ ওড়িয়া ভাষা বুঝতে পারতেন না তবু তাঁকে ওড়িয়া ভাষাতেই পড়াশুনা আরম্ভ করতে হয়।গাম্ভারিয়া স্কুলের পর বহড়দা এম. ই. স্কুলে তাঁকে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। মেধাবী রঘুনাথ ১৯২২ সালে এম. ই. পাশ করেন এবং বারিপাদা হাইস্কুল অফ্ ময়ূরভঞ্জ (বর্তমানে এম. কে. সি. হাইস্কুল)-এ ভর্তি হন। এখান থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯২৪ সালে (মতান্তরে ১৯২৮ সালে)। ১৯৩১-৩২ সালে বারিপাদা পাওয়ার হাউস থেকে Apprenticeship করেন। তারপর, ময়ূরভঞ্জের দেওয়ান ড. পি. কে. সেন-এর উদ্যোগে রঘুনাথ কোলকাতা, শ্রীরামপুর, গোসাবা থেকে Industrial training লাভ করেন। পড়াশুনায় তাঁকে ইতি টানতে হয় কেন না দারিদ্র্যতার জন্য তিনি আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেন নি।

পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু এর কর্ম জীবন (Work life of Pandit Raghunath Murmu)

রঘুনাথ মুরমুর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৩০-৩১ সালে লোকগণনার অস্থায়ী কর্মী হিসেবে। এখানে কিছুদিন কাজ করার পর বারিপাদার পূর্ণ-চন্দ্ৰ ইন্ডাসট্রিয়াল ইনসটিটিউট-এ Instructor হিসাবে কাজ করেন। ১৯৩৩ সালে রঘুনাথ মুরমু বড়ামতাড়িয়া মডেল ইউ. পি. স্কুলে ইনডাসট্রিয়াল শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। কিছুদিন পরেই এখানকার প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৪৬ সালে রায়রংপুর হাইস্কুলে Promotion দিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়। ১৯৪৬ সালেরই ফেব্রুয়ারী মাসের ছ'তারিখে তিনি স্বেচ্ছায় চাকরী থেকে ইস্তফা দেন। ছোটবেলায় রঘুনাথ যখন স্কুলে পড়তেন তখন ওড়িয়া ভাষায় পড়াশুনা করা তাঁর পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়েছিল। মাতৃভাষায় কেন পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না সেকথা তাঁর মনে প্রশ্ন জাগায়। তিনি জানতে পারেন, নিজের মাতৃভাষার লিপি নেই বলে মাতৃভাষায় পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। তারপর থেকেই সাঁওতালি ভাষার জন্য লিপি উদ্ভাবনের কথা তাঁর মাথায় আসে। আসলে, সাধুরামচাঁদ মুরমুর মতোই রঘুনাথ মুরমুও বুঝেছিলেন যে, সাহিত্যের বিকাশ ব্যতিত জাতির বিকাশ অসম্ভব এবং সাহিত্যের বিকাশে নিজস্ব লিপি একান্তভাবেই প্রয়োজন। তাই মামা সাওনা মুরমুর সঙ্গে বহু আলোচনার পর, অসম্ভব পরিশ্রম করে সাঁওতালি ভাষার ১৯২৫ সালে লিপির সৃষ্টি করেন। নাম দেন‘অলচিকি’

মিশনারীগণ খ্রীশ্চান ধর্মপ্রচারক ছিলেন। তাঁরা ধর্মপ্রচারের আগ্রহে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন। তাঁদের পৃষ্টপোষকতায় শিক্ষিত সাঁওতাল যাঁরা খ্রীশ্চান, তাঁরা রোমান লিপির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেন এবং ঐ লিপিতেই সাঁওতালি ভাষা লেখা ও পড়ার কাজ চালান। সামান্য সংখ্যক খ্রীশ্চান তথা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বাইরে যে কয়েক লক্ষ সাঁওতাল ছিলেন তাঁদের কাছে তখন সাঁওতালি ভাষার লিপি নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দেয় নি, কারণ স্কুল কলেজের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল খুবই ক্ষীণ। পরবর্তীকালে যখন একটু একটু করে তাঁদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটে তখন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সাঁওতাল ছাত্রছাত্রীরা যারা স্থানীয় ভাষার লিপি অর্থাৎ বাংলায় বাংলা, বিহারে দেবনাগরী, উড়িষ্যায় ওড়িয়া লিপির মাধ্যমেই মাতৃভাষার পাঠ নিয়েছে। তারপর ১৯২৫ সালে রঘুনাথ মুরমু সাঁওতালির জন্য ‘অলচিকি’ লিপির উদ্ভাবন করেন। ১৯৩৮ সালে অলচিকি প্রসারের জন্য কাঠের ছাপা মেসিন তৈরি করেন। ১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বারিপাদার এক সভায় রঘুনাথ ছাপা মেসিন ও অলচিকি-কে  জনসমক্ষে আনেন। মহারাজ তা দেখেন এবং খুশি হন। তারপরই প্রকৃতপক্ষে ‘অলচিকি’ প্রচারের কাজ শুরু হয়। জামশেদপুরের খেরওয়াল জারপা সমিতিরসহযোগিতা লাভ করেন।

তারপর কোলকাতার স্বদেশী টাইপ ফাউন্ড্রিতে গিয়ে রঘুনাথ ‘অলচিকি’-র টাইপ তৈরী করান। মুনিরাম বাসকের উদ্যোগে ‘চাঁদান প্রেস’-এর স্থাপনা হয়। অলচিকি লিপিতে মুদ্রণের কাজ ত্বরান্বিত হয়। অলচিকি প্রচারের জন্য পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু ১৯৬০ সালে “আদিবাসী সোসিও এডুকেশনাল এ্যান্ড কালচারাল এসোসিয়েশন' (ASECA) বা আদিবাসী সমাজ-শিক্ষণ ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরী করেন। উড়িষ্যা, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে এই সংগঠন ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি গড়ে উঠে All India (Adibasi ) Santal Council। অলচিকি প্রচারের আন্দোলন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের ব্যাপকতা পশ্চিমবঙ্গে-ই ছিল বেশি। তাই আমরা দেখি পশ্চিমবঙ্গ সরকার অলচিকি লিপিকে সাঁওতালি ভাষার উপযোগী মনে করে ১৯৭৯ সালের জুন মাসের দু’তারিখে নীতিগত ভাবে স্বীকৃতি দেয়। তৎসত্ত্বেও বলা যায়, স্থানীয় ভাষার বা প্রাদেশিক ভাষার লিপিতে অভ্যস্থ থাকার দরুণ অনেকেই অলচিকি লিপিকে মেনে নিতে পারেন নি। বিতর্কের ঝড় উঠে। সাঁওতালদের মধ্যে লিপি নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও এইটুকু বলা যায়, রঘুনাথ মুরমু ভাষাতত্ত্বজ্ঞ ছিলেন না সত্য, কিন্তু নিজে সাঁওতাল ছিলেন। আবাল্য সাঁওতালি তাঁর মুখের ভাষা ছিল। সুতরাং ধ্বনি বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান তাঁর অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। সেই ধ্বনি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তিনি অলচিকি লিপির কল্পনা করেন। তাঁর পরিকল্পনায় কিছু কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি থাকা অসম্ভব নয় তবে তা সংশোধন করার প্রয়োজন আছে এবং তা ভাষাবিদ পণ্ডিতদের সহৃদয় উপদেশ নির্দেশেই তা সম্ভব হতে পারে। সাঁওতাল জাতির যথার্থ শিক্ষা বিস্তারে অলচিকি লিপির উদ্ভাবনেই থেমে থাকেন নি পণ্ডিত রঘুনাথ। শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, তাদের সম্পর্কে দরদী মন নিয়ে এবং বিশেষ শিক্ষাভাবনা ও কল্পনার মিলনে লিখেছেন সচিত্র শিশু পাঠ্য বই “অল চেমেদ”। স্বদেশি ফাউন্ড্রির নিজস্ব কাঠের হরফে প্রথমে ছাপার কাজ শুরু। কাঠের ব্লক তৈরি করেছেন নিজে। ব্লকে নিজেই খোদাই করেছেন পরিচিত জীবজন্তু বা প্রাকৃতিক দৃশ্যের শিল্পরূপ। ভেড়া লড়াই, শিয়াল-ছাগলের বুদ্ধির লড়াই, ইঁদুর ও জাঁতাকল, নাতিকে বৃদ্ধের তির-নিক্ষেপ শেখানো, উড়ন্ত উড়োজাড়াজ, চন্দ্রালোকিত রাত্রি, প্রভাতকালীন মনোরম প্রাকৃতিক রূপ ইত্যাদি বিষয় আশ্চর্য সুন্দর শিল্পময়তায় কাঠের ব্লকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। (পরবর্তীকালে যথারীতি ধাতুনির্মিত ব্লক ব্যবহৃত)। “অল উপরুম” বইটিও শিশুপাঠ্য। একগুচ্ছ চিরন্তন সত্যকথা বা প্রাকৃতিক নিয়ম লিখেছেন শিশু মনস্তত্ত্বের উপযোগী করেই। “পারশি পহা”-য় অলচিকি লিপির প্রাথমিক রূপ এবং “পারশি অপাৎ”-বইয়ে অলচিকি লিপির অঙ্কুরোদ্গম। জাতির উন্নতিতে স্বাস্থ্যই সম্পদ—এই সমাজহিতকর ভাবনা তাঁর “দাড়েগে ধন” নাটকে সুন্দরভাবে চিত্রিত। অলচিকি লিপিতে লেখা ধারাপাত, যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ ইত্যাদি শিশুপাঠ্য গণিত শিক্ষা ‘এলখা” বইয়ে বিধৃত। “পারশি ইতুন” তাঁর লেখা ইংরেজি শিক্ষার বই। বারিপাদার কালকাপুরে, ১৯৭৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি অবধি তিনি নিজে এই বই থেকে ছাত্রদের শিক্ষা দেন। সাঁওতালি শিক্ষার জন্য সহজ ব্যাকরণ বই “রণড” লিখেছেন। বইটিতে তিনি বলেছেনসাঁওতালি ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার মিলের কিছু কথা। সামাজিক জীবনে সাঁওতালদের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ বিষয়ক নীতি বিধানের কথা লিখেছেন “বাঁখেড়” বইয়ে। সমগ্র সাঁওতাল জাতির আত্মজিজ্ঞাসা ও প্রেরণামূলক অগ্রগতির ভাবনা “রাঃ আদড়” বইয়ে চিত্রিত করেছেন। “আমরা তো প্রথম ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম, বর্তমানে কেন পিছিয়ে রইলাম”— এ ধরণের আত্মজিজ্ঞাসায় নিজস্ব জাতীয় বিশ্বাসের শিকড়ে স্বজাতির মানুষকে নিয়ে যেতে তিনি চেয়েছেন। উন্নয়নশীল সাঁওতাল জাতি, তাঁর নাটকের শ্রব্যদৃশ্যময় রূপের (Audio-Visual) মাধ্যমে যাতে গণসংগ্রামের প্রেরণা লাভ করতে পারে—ভবিষ্যৎ জীবনের চলার পথে, সেজন্য “খেরওয়াল বীর” নাটক লিখেছেন। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষায় এবং ১৯৬২ সালে অলচিকি লিপিতে প্রকাশ। সাঁওতাল সমাজের ঐতিহ্যরক্ষায় সিধু-কানুর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক সংগ্রামের বীরত্বপূর্ণ দিক নিয়ে তাঁর লেখা নাটক “সিধু-কানু”। “বিদু-চাঁদান” নাটকটি তাঁর খুবই জনপ্রিয় রচনা। ১৯৪২ সালে ওড়িয়া ভাষায়, ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষায় এবং ১৯৫২ সালে অলচিকি লিপিতে প্রকাশ করেন। পণ্ডিত রঘুনাথ স্বয়ং এ নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। তাঁর উপদেশমূলক গানের বই “লাক্চার”। তাঁর “হিতীল” গ্রন্থ তিনখণ্ডে মহাকাব্যধর্মী। তাঁর আরও কিছু লেখা আছে। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে আলাদা গ্রন্থ রচনার অবকাশ আছে।” (রঘুনাথ মুরমু সাঁওতালি সাহিত্য ও অলচিকি আন্দোলন—ড. শান্তি সিংহ, )।

পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু সাঁওতালি সাহিত্যে এর অবদানের জন্য সম্মাননা লাভ

পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিভার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। যেমন— 

  • (১) ময়ূরভঞ্জ আদিবাসী মহাসভা তাঁকে “গুরু-গমকে”  উপাধিতে ভূষিত করেন।
  • (২) মিষ্টার এম. ডি. জুলিয়াস টিগ্গা পণ্ডিত মুরমুকে “Great Inventor and Dramatist” বলে অভিহিত করেছেন।
  • (৩) রাঁচির ‘ধুমকুরিয়া রাঁচি’ নামক সংস্থা পণ্ডিত রঘুনাথকে Doctorate of Literature উপাধিতে ১৯৫৭ সালের ৮ই মার্চ তারিখে সম্মানিত করেন।
  • (৪) প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ চারুলাল মুখার্জী তাঁকে “Priests of the Tribes" অভিধায় ভূষিত করেছেন।
  • (৫) ওড়িশার তৎকালীন উন্নয়নমন্ত্রী রামজিৎ সিং বারিহা অসাধারণ বাক্‌নৈপুণ্যের জন্য পণ্ডিত মুরমুকে “A great orator with Charming Voice” আখ্যা দিয়েছেন।
  • (৬) আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ অধ্যাপক মার্টিন ওরেন্স তাঁকে “Spiritual Guru” বলেছেন। জানা যায়, অধ্যাপক ওরেন্স তাঁর ‘The Santals’ গ্রন্থে পণ্ডিত মুরমু-র সৃজন Original Santali Script, The OL CHIKI-র উল্লেখ করেছেন।
  • (৭) আদিবাসীদের বিশিষ্ট নেতা জয়পাল সিং তাঁকে “পণ্ডিত” আখ্যা দেন।
  •  (৮) ওড়িশা সাহিত্য একাডেমি ১৯৭৮ সালের ২৮শে মার্চ তাঁকে “Founder of Santali Language Literature and inventor of OL-CHIKI" অভিধায় শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে।
  • (৯) ১৯৭৯ সালের ২রা জুন তারিখে পশ্চিমবঙ্গ সরকার অলচিকি লিপিকে সাঁওতালি ভাষার উপযোগী মনে করে নীতিগতভাবে স্বীকৃতি দেয়।
  •  (১০) ১৯৭৯ সালের ১৭ নভেম্বর পুরুলিয়া জেলার হুড়া থানার কেন্দবনা মাঠে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমুকে সংবর্ধনা জানান। এতে তাঁকে “Father of OL-CHIKI” আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
  • (১১) ASECA পশ্চিমবঙ্গ শাখার পক্ষ থেকে ১৯৮০ সালের ৯ই মার্চ তারিখে বাঁকুড়া জেলার সারেঙ্গায় পণ্ডিত মুরমুকে সংবর্ধনা জানানো হয়।
  • (১২) বালেশ্বরের উত্তর উড়িষ্যা সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলনের পক্ষ থেকে ১৯৮০ সালের ১৪ই এপ্রিল তারিখে রঘুনাথকে “অলচিকির স্রষ্টা” অভিধায় সম্মানিত করেন।

পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু এর প্রকাশিত গ্ৰন্থ ও নাটক (Books and plays published by Pandit Raghunath Murmu)

পেশায় শিক্ষক পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু আজীবন সাঁওতালি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে কাজ করে গেছেন। তাঁর প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা দেওয়া হল—

  1. তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ হল গানের। নাম “হর সেরেঞ” (পথের গান) প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে।
  2. প্রথম প্রকাশিত যাত্রাপালা “বিদু চাঁদান” (বিদু ও চাঁদন)। প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পণ্ডিত মুরমুর আমলে এই যাত্রাপালাটি সারা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল। এখনও এটি মঞ্চস্থ হলে দর্শক সামলানো মুস্কিল হয়ে পড়ে। পণ্ডিত মুরমুর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি বিদু ও চাঁদান  আজো সাঁওতালদের মুখে মুখে শোনা যায়। বলা যায়, চরিত্র দুটিকে দেব-দেবীর তুল্য সম্মান জানানো হয়।
  3. ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হয় “ঞেল জং লাগিদ অল” (দেখার জন্য লেখা) গ্রন্থ।
  4. “অল চেমেদ” গ্রন্থটির প্রকাশ সাল এখনও অজানা।
  5. পণ্ডিত মুরমু-র আরেকটি যাত্রাপালা হল “দাড়েগে ধন” (শক্তিই সম্পদ) এটি ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয়।এই যাত্রাপালাটিও বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।
  6. তাঁর অপর যাত্রাপালার নাম “খেরওয়াড় বীর” (বীর খেরওয়াল) যা “বিদু-চাঁদান”-(bidhu chandan)এর মতোই সারা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় সাড়া জাগিয়েছিল। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে।
  7. অলচিকি লিপিতে লেখা অভ্যাস করার জন্য “অল উপরুম” (বর্ণ-পরিচয়) গ্রন্থটি রচনা করেন। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে।
  8. “বাহা” (Baha)সাঁওতাল জাতির অন্যতম প্রধান উৎসব। এই উৎসবের প্রচলিত গানকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন তাঁর “বাহা সেরেঞ” (বাহা-গান) গ্রন্থে। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে।
  9. “হিতীল” (মঙ্গলবাণী) সাঁওতাল জাতির সৃষ্টিকাহিনী বর্ণীত কাব্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থে পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু উল্লেখ করেছেন যে, 'সারনা রেয়াঃ হিত্ লাইগে হিতৗল’ অর্থাৎ সারনা ধর্মের জন্য মঙ্গলময় দিকই “হিতীল” গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং বলা যায়, ধর্ম ভাবনার ক্ষেত্রে অগ্রজ কবি সাধুরাম চাঁদ মুরমু যেমন “সারি ধর্মে’-র প্রবক্তা তেমনি রঘুনাথ মুরমু হলেন ‘সারনা’ ধর্মের প্রবক্তা। তিন খণ্ডে বিভক্ত ‘হিতৗল’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। ১৯৯০ সালে গ্রন্থটি পুনর্মুদ্রিত হয়।
  10. শিশুদের উপযোগী গণিত শিক্ষার জন্য “এলখা” (গণিত) গ্রন্থের রচনা করেন। সহজ উপায়ে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ শেখার উপযুক্ত শিশু গ্রন্থ। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে।
  11. “লাকচার সেরেঞ” (সংস্কৃতি বিষয়ক গান) পণ্ডিত মুরমু-র অন্যতম প্রখ্যাত গানের বই। গ্রন্থ নামের সঙ্গে সংস্কৃতি (লাকচার) শব্দের ব্যবহার করা হলেও এতে সাঁওতাল জাতির ঐতিহ্য পরম্পরা সংস্কৃতির কোন সংগ্রহমূলক গান এতে নেই। এটি স্বরচিত গানের বই। এই গ্রন্থের গানে পণ্ডিত মুরমু সাঁওতাল জাতির সামনে এগিয়ে চলার পথ নির্দেশ করে গেছেন। এই গ্রন্থের বহু গান ছড়ার মতো সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মুখে মুখে শোনা যায়। বলা যায় এটি উপদেশমূলক গ্রন্থ।
  12. বর্ণ পরিচয়ের অনুসরণে রঘুনাথ মুরমু ভাষা পরিচয় বা ভাষা শিক্ষারও গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত গ্রন্থটির নাম “পারসি ইতুন” (ভাষা শিক্ষা)। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত এটি তাঁর ইংরেজী শিক্ষার গ্রন্থ।
  13. “বাঁখেড়” (স্তোত্র পাঠ) তাঁর অন্যতম গ্রন্থ। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহকে কেন্দ্র করে সাঁওতাল জাতির যে সব নীতি বিধান রয়েছে তা-কেই এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে।
  14. “পারসি পহা” (ভাষা মুকুল) গ্রন্থে অলচিকির রূপকে বিধৃত করেছেন। অলচিকি লিপি শেখার এটি অন্যতম সহজবোধ্য গ্রন্থ। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে।
  15. পণ্ডিত মুরমু কেবলমাত্র ভাষা ও লিপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি। সাঁওতালি ভাষার জন্য সহজ ব্যাকরণ গ্রন্থেরও রচনা করেন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটির নাম “রণড়” (ব্যাকরণ)।
  16. “পারসি অপাৎ” (ভাষা-অঙ্কুর) অলচিকি লিপি শেখার গ্রন্থ। লিপির প্রাথমিক পর্যায় অতিক্রম করে দ্বিতীয় পর্যায়ের রূপ এতে দেখানো হয়েছে। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘পারসি’ অর্থে ভাষা বোঝায়। সান্তাড়ী পারসি বা সাঁওতালি ভাষা। “পারসি পহা” এবং “পারসি অপাৎ” গ্রন্থ দুটির নামকরণে পণ্ডিত মুরমু ‘পারসি’ শব্দের ব্যবহার করলেও, গ্রন্থদুটি আসলে লিপি শিক্ষার অর্থাৎ অলচিকি-র রূপ এতে বিধৃত করা হয়েছে। ভাষা ও লিপি একাকার হয়ে গেছে।
  17. “সিদু-কানহু হুল” (সিদু-কানু সংগ্রাম) তাঁর অন্যতম যাত্রাপালা। ১৮৫৫-৫৬ সালের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত এই যাত্রাপালায় সংগ্রামের বীরত্বপূর্ণ দিককে তুলে ধরেছেন। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে।
  18. পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমুর শেষ প্রকাশিত গ্রন্থটি হল রাঃ আঁদোড় (কান্নার রোল)। প্রকাশ সাল জানা যায় নি।

পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু এর পরলোকগমন (Death of Pandit Raghunath Murmu)

পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু কেবলমাত্র ‘অলচিকি’ লিপির স্রষ্টাই ছিলেন তা নয়, পাশাপাশি কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার (যাত্রাপালা রচয়িতা) এবং বিদগ্ধ দার্শনিকও ছিলেন। তাঁর আদর্শে সাঁওতাল জনমানসে আলোড়নের সৃষ্টি হয়। স্বাধীনোত্তর ভারতে যখন ভাষা ভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন শুরু হয় তখন পণ্ডিত মুরমু-রই আদর্শে দীক্ষিত সুনারাম সরেনের নেতৃত্বে সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধ হন। ভাষা ভিত্তিক রাজ্যের দাবি তাঁরাও করেন অর্থাৎ সাঁওতালি ভাষার ভিত্তিতে সাঁওতালদের জন্য পৃথক রাজ্য। কিন্তু অদৃষ্টের চরম পরিহাস, স্বাধীন ভারতের সরকার ময়ূরভঞ্জের গুঁডুরিয়ায় ১৯৪৮ সালে নিরস্ত্র সাঁওতালদের জমায়েতে নির্বিচারে গুলি চালায়। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডকে স্মরণ করিয়ে দেয়। পণ্ডিত মুরমুই যে সাঁওতালদের তাত্ত্বিক নেতা, তা সরকার বুঝতে পেরে তাঁকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জারি করেন। তিনি আত্মগোপন করেন ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায় নি। এ হেন এক বিরল ব্যক্তিত্ব ১৯৮২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী তাঁর কর্মযজ্ঞ অসমাপ্ত রেখে পরলোকগমন করেন

FAQ

Where was Raghunath Murmu born?

Raghunath Murmu was born in Odisha, India.

Who was called as Guru Gomke?

Pandit Raghunath Murmu Guru Gomke is a title given to Raghunath Murmu, who is considered as the founder of the modern Santali language and script. He is a well-known figure in the history of Santali language and culture. He wrote the first Santali-English dictionary and also developed a new script for the language, known as Ol Chiki script, which is widely used today.

Who invented the Ol Chiki script?

Raghunath Murmu is credited with inventing the Ol Chiki script, also known as Ol Cemet, for the Santali language. He developed the script in the 1920s, as a way to preserve and promote the Santali language and culture. Prior to this, Santali had been written using the Bengali script and other scripts, which many Santali speakers found difficult to read and write. Ol Chiki script is widely used today, and it is officially recognized script for writing Santali Language in India.

পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু জীবনী

Previous Post Next Post