কলকাতার সেরা ১০টি স্ট্রিট ফুড: স্বাদের শহর ও তার জাদুকরি স্বাদ
কলকাতার নামের সঙ্গে যে জিনিসগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো এখানকার স্ট্রিট ফুড। কলকাতার প্রতিটি অলি-গলিতে লুকিয়ে আছে নানান স্বাদের সম্ভার। এই শহর শুধু সংস্কৃতির রাজধানী নয়, এটি ভোজনরসিকদের স্বর্গরাজ্যও বটে। এখানে পাওয়া যায় এমন কিছু খাবার, যা একবার খেলে বারবার মন চাইবে। স্ট্রিট ফুড শুধু পেট ভরানোর জন্য নয়, এটি কলকাতার জীবনযাত্রার একটা অংশ। বন্ধু-বান্ধব, পরিবার বা একা একা, যে কোনো সময় একটু অবসর পেলেই বাঙালিরা বেরিয়ে পড়ে স্ট্রিট ফুডের খোঁজে। আসুন, এক ঝলকে দেখে নিই কোলকাতার সেরা ১০টি স্ট্রিট ফুড, যা আপনার মন এবং পেট দুই-ই ভরিয়ে দেবে।
১. ফুচকা (Phuchka)
ফুচকা শুধু একটি খাবার নয়, এটি একটি অনুভূতি। গোল, মচমচে ফুচকার ভেতরে থাকে সেদ্ধ আলুর পুর, যা তেঁতুল জল আর মশলার অসাধারণ মিশ্রণে তৈরি। এটি জিভে দিলেই এক অন্যরকম স্বাদ অনুভব করা যায়।
ইতিহাস: ফুচকার উৎপত্তি নিয়ে নানান মতবাদ রয়েছে, তবে এটি যে কলকাতার ফুড কালচারের অন্যতম অঙ্গ, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কোথায় পাওয়া যায়: কলকাতার প্রতিটি রাস্তার মোড়ে ফুচকা পাওয়া যায়। তবে গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেট, এবং দক্ষিণাপণ-এর ফুচকা বেশ জনপ্রিয়।
বিশেষত্ব: তেঁতুল জলের টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদ আর আলুর পুরের মশলার মিশ্রণ।
দাম: সাধারণত আনুমানিক ১০-২০ টাকায় ৪-৬টি ফুচকা পাওয়া যায়।
২. রোল (Roll)
এগ রোল, চিকেন রোল, মটন রোল—রোল ছাড়া কলকাতার স্ট্রিট ফুড অসম্পূর্ণ। একটি পাতলা পরোটার মধ্যে ডিম, পেঁয়াজ, সস এবং ঝাল মশলার মিশ্রণ দিয়ে তৈরি হয় এটি।
ইতিহাস: কথিত আছে, ধর্মতলা এলাকার কিছু রেস্টুরেন্ট প্রথম রোল তৈরি করা শুরু করে, যা পরে সারা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ে।
কোথায় পাওয়া যায়: নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাট, পার্ক স্ট্রিট - এই সমস্ত জায়গায় বিখ্যাত রোলের দোকান রয়েছে।
বিশেষত্ব: রোল বিক্রেতারা আপনার চোখের সামনে রোলটি তৈরি করে, যা এর আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেয়।
দাম: আনুমানিক ৩০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রোল পাওয়া যায়।
৩. চপ ও কাটলেট (Chop and Cutlet)
বিকেলে চায়ের সঙ্গে বাঙালিরা চপ ছাড়া কিছু ভাবতেই পারে না। ডিমের চপ, ভেজ চপ, চিকেন কাটলেট, ফিশ ফ্রাই—সবই বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ইতিহাস: ব্রিটিশ আমল থেকে কলকাতায় কাটলেট ও চপ বেশ জনপ্রিয়। সেই সময়ের বাঙালি বাবুরা এটিকে নতুন রূপে গ্রহণ করেন।
কোথায় পাওয়া যায়: কলেজ স্ট্রিট, কালীঘাট, এবং শ্যামবাজার এলাকায় বহু পুরোনো ও বিখ্যাত চপের দোকান রয়েছে।
বিশেষত্ব: দোকানের নামকরা মশলার মিশ্রণে তৈরি চপগুলো মচমচে আর সুস্বাদু হয়।
দাম:প্রতিটি চপের দাম আনুমানিক ১০-৪০ টাকার মধ্যে।
৪. ঘুগনি (Ghugni)
ঘুগনি হলো শুকনো মটর দিয়ে তৈরি এক ধরনের ডিশ, যা পেঁয়াজ, টমেটো, ধনেপাতা এবং বিভিন্ন মশলার সঙ্গে মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়।
ইতিহাস: ঘুগনি মূলত বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। এটি কলকাতার স্ট্রিট ফুড হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
কোথায় পাওয়া যায়: নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাট এবং প্রায় সব রাস্তার মোড়ে ঘুগনি পাওয়া যায়।
বিশেষত্ব: মশলার সঠিক মিশ্রণ এবং সামান্য লেবুর রস এর স্বাদকে অনন্য করে তোলে।
দাম: এক প্লেট ঘুগনির দাম আনুমানিক ১৫-৫০ টাকার মধ্যে।
৫. মোমো (Momo)
মোমো মূলত তিব্বতীয় খাবার, কিন্তু কলকাতার মোমোপ্রেমীরা এটিকে নিজেদের করে নিয়েছে। এটি ভেজ বা চিকেন পুর দিয়ে তৈরি হয় এবং গরম স্যুপ ও ঝাল চাটনির সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।
ইতিহাস:নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে এটি কলকাতায় আসে এবং দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
কোথায় পাওয়া যায়: পার্ক স্ট্রিট, এসপ্ল্যানেড এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটি সংলগ্ন এলাকায় দারুণ মোমো পাওয়া যায়।
বিশেষত্ব: মোমো বিক্রেতারা নিজেদের হাতে তৈরি স্পেশাল ঝাল সস দিয়ে এটি পরিবেশন করে।
দাম: এক প্লেট মোমোর দাম আনুমানিক ৫০-১০০ টাকার মধ্যে।
৬. চাউমিন ও হাক্কা নুডলস (Chowmein and Hakka Noodles)
চাইনিজ খাবারের প্রতি বাঙালির ভালোবাসা নতুন নয়। চাউমিন এবং হাক্কা নুডলস কলকাতার স্ট্রিট ফুড কালচারের অন্যতম অংশ।
ইতিহাস: কলকাতা যেহেতু চিনেপাড়ার (চাইনা টাউন) জন্য বিখ্যাত, তাই চাইনিজ খাবার সহজেই এখানকার স্ট্রিট ফুডের তালিকায় জায়গা করে নেয়।
কোথায় পাওয়া যায়: বউবাজার, ঢাকুরিয়া এবং নিউ মার্কেট এলাকায় হাক্কা নুডলস খুব জনপ্রিয়।
বিশেষত্ব: স্ট্রিট ফুড বিক্রেতারা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে মশলা মিশিয়ে এটি তৈরি করে, যা অন্য কোনো চাইনিজ রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় না।
দাম: এক প্লেট চাউমিনের দাম আনুমানিক ৫০-৮০ টাকার মধ্যে।
৭. আলুর দম ও লুচি (Alur Dom and Luchi)
আলুর দম আর লুচির এই যুগলবন্দী কলকাতার স্ট্রিট ফুডের অন্যতম আকর্ষণ। মসৃণ লুচির সঙ্গে মশলাদার আলুর দমের স্বাদ তুলনাহীন।
ইতিহাস: আলুর দম ও লুচি হলো বাঙালি প্রাতরাশের এক অতি জনপ্রিয় খাবার। পরে এটি স্ট্রিট ফুড হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
কোথায় পাওয়া যায়: কলেজ স্ট্রিট, শিয়ালদহ এবং গড়িয়ার মতো এলাকায় এই খাবারটি বেশ জনপ্রিয়।
বিশেষত্ব: হালকা সুগন্ধযুক্ত গরম লুচি আর স্পেশাল মশলা দিয়ে তৈরি আলুর দম।
দাম: এক প্লেটের দাম আনুমানিক ৩০-৭০ টাকার মধ্যে।
৮. জিলিপি (Jilipi)
কলকাতা শহর যদি কোনো মিষ্টি দিয়ে পরিচিত হয়, তবে সেটি হলো জিলিপি। গরম গরম জিলিপি আর তার মিষ্টি স্বাদ যেকোনো মানুষকে মুগ্ধ করে।
ইতিহাস: জিলিপি ভারতের প্রাচীন খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি কলকাতায় সকালের নাস্তা হিসেবেও খুবই জনপ্রিয়।
কোথায় পাওয়া যায়: বড়বাজার, শিয়ালদহ এবং কলেজ স্ট্রিট এলাকায় জিলিপির অনেক বিখ্যাত দোকান আছে।
বিশেষত্ব: হাতে বানানো জিলিপি আর তার মিষ্টির সিরায় ভেজানো সুমিষ্ট স্বাদ।
দাম: প্রতি ১০০ গ্রাম জিলিপির দাম আনুমানিক ১৫-৩০ টাকা।
৯. ঘটি-গরম (Ghoti-Garam)
ঘটি-গরম হলো মুড়ির একটি বিশেষ রূপ। মুড়ি, ছোলা, বাদাম, পেঁয়াজ, শসা, এবং বিভিন্ন মশলার মিশ্রণে তৈরি হয় এই খাবার।
ইতিহাস: ঘটি-গরমের নাম এসেছে সেই বিক্রেতাদের কাছ থেকে, যারা একটি ধাতব ঘটিতে গরম মুড়ি এবং অন্যান্য উপকরণ রাখেন।
কোথায় পাওয়া যায়: সাধারণত বাসস্ট্যান্ড, ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম এবং সিনেমা হলের বাইরে এটি দেখতে পাওয়া যায়।
বিশেষত্ব: ঘটি-গরম এর মশলার মিশ্রণ আপনাকে এক দারুণ স্বাদ দেবে।
দাম: এক প্লেট ঘটি-গরমের দাম আনুমানিক ১০-২০ টাকার মধ্যে।
১০. তেলেভাজা ও চা (Telebhaja and Tea)
তেলেভাজা আর গরম চা - এই জুটি কলকাতার স্ট্রিট ফুডের এক প্রতীক। পেঁয়াজি, বেগুনি, ফুলুরি, ডিমের চপ—তেলেভাজার তালিকা অনেক লম্বা।
ইতিহাস: বাঙালিরা নিজেদের ঘরেও তেলেভাজা তৈরি করে। এটি একটি সাধারণ বিকেলের নাস্তা হিসেবে শুরু হয়েছিল এবং পরে স্ট্রিট ফুড হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
কোথায় পাওয়া যায়: প্রায় প্রতিটি রাস্তার মোড়ে চা ও তেলেভাজার দোকান দেখা যায়।
বিশেষত্ব: গরম তেল থেকে সদ্য ভাজা তেলেভাজা আর গরম চা একসাথে খেলে মন ভরে যায়।
দাম: প্রতিটি তেলেভাজার দাম আনুমানিক ৫-১৫ টাকার মধ্যে।
১১. কোলকাতা বিরিয়ানি (Kolkata Biryani)
কনি তার হালকা মশলা এবং আলু ও ডিমের জন্য বিখ্যাত। এটি একটি খাবারের চেয়ে বেশি, একটি অভিজ্ঞতা।
ইতিহাস: কলকাতার বিরিয়ানির ঐতিহ্য মুঘল আমল থেকে আসে, যা বাংলায় এসে নতুন রূপে বিকশিত হয়।কোথায় পাওয়া যায়: সেরা বিরিয়ানি পাবেন আর্দেন, নিজামস, হান্ডি, আমিনিয়া, এবং আহমদিয়া-র মতো বিখ্যাত রেস্টুরেন্টে।
বিশেষত্ব: কলকাতার বিরিয়ানিতে প্রধান উপাদান হল বাসমতি চাল, মশলা, আলু এবং ডিম। এটি সাধারণত চিকেন বা মাটনের সাথে পরিবেশন করা হয়।
১২. চপ (Chop ) মুখরোচক ও ঐতিহ্যবাহী
ঝালমুড়ি বা অন্য কোনো জলখাবারের সাথে চপ একটি দারুণ পছন্দ। এটি এক কথায় একটি আইকনিক স্ট্রিট ফুড।
ইতিহাস: চপ ও কাটলেট ব্রিটিশ আমলে ভারতে আসে, যা পরে বাঙালি রন্ধনশৈলীতে মিশে যায় এবং তার নিজের রূপ পায়।
কোথায় পাওয়া যায়: সেরা চপ ও কাটলেট পাবেন কলেজ স্ট্রিট, গড়িয়াহাট, এবং দক্ষিণ কলকাতার কিছু নির্দিষ্ট দোকানে।বিশেষত্ব: আলু, ডিম, চিংড়ি, মাছ, বা মাংসের পুর দিয়ে তৈরি হয় চপ। এটি গরম তেলে ভাজা হয়, যার ফলে একটি খাস্তা আবরণ তৈরি হয়।
দাম:: আনুমানিক ২০-৪০ টাকা।
কোলকাতার স্ট্রিট ফুড চেষ্টা করার কিছু টিপস
- স্বাস্থ্যবিধি: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দোকানে খাবার চেষ্টা করুন।
- দাম জিজ্ঞেস করুন: খাবার কেনার আগে দাম জিজ্ঞেস করে নিন।
- সঠিক সময়: খাবার চেষ্টা করার সেরা সময় হল সন্ধ্যাবেলা।
কোলকাতার স্ট্রিট ফুড চেষ্টা করার কিছু টিপস
- স্বাস্থ্যবিধি: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দোকানে খাবার চেষ্টা করুন।
- দাম জিজ্ঞেস করুন: খাবার কেনার আগে দাম জিজ্ঞেস করে নিন।
- সঠিক সময়: খাবার চেষ্টা করার সেরা সময় হল সন্ধ্যাবেলা।
উপসংহার
কোলকাতার স্ট্রিট ফুড শুধুমাত্র খাবার নয়, এটি একটি অভিজ্ঞতা। শহরের অলি-গলিতে লুকিয়ে থাকা এই স্বাদগুলো কোলকাতার প্রাণ। তাই একবার এই শহরে এলে এই জাদুকরি স্বাদগুলো চেখে দেখতে ভুলবেন না।
সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQs)
১. কলকাতার স্ট্রিট ফুড কি খুব স্বাস্থ্যকর?
কিছু স্ট্রিট ফুড স্বাস্থ্যকর না হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাইজিন মেনেই তৈরি করা হয়। তবে সতর্ক থাকা জরুরি।
২. কোথায় সেরা রোল পাওয়া যায়?
নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাট এবং পার্ক স্ট্রিট-এ বিখ্যাত রোলের দোকান রয়েছে।
৩. কলকাতার স্ট্রিট ফুড কি খুব ঝাল?
কিছু খাবার ঝাল হতে পারে, তবে আপনি বিক্রেতাকে আপনার স্বাদ অনুযায়ী ঝাল কমাতে বলতে পারেন।
৪. কি কি মিষ্টি স্ট্রিট ফুড চেষ্টা করা যেতে পারে?
জিলিপি, রসগোল্লা এবং রসমালাই-এর মতো মিষ্টি স্ট্রিট ফুড চেষ্টা করা যেতে পারে।
৫. স্ট্রিট ফুড কখন খাওয়া উচিত?
সাধারণত সন্ধ্যাবেলা স্ট্রিট ফুড উপভোগ করার সেরা সময়।
৬. কলকাতায় কি নিরামিষাশীদের জন্য ভালো স্ট্রিট ফুড আছে?
হ্যাঁ, লুচি-আলুর দম, ঘুগনি, ভেজ রোল, ঘটি-গরম এবং বিভিন্ন ধরনের চপ নিরামিষাশীদের জন্য দারুণ বিকল্প।
৭. কোন এলাকায় সবচেয়ে বেশি স্ট্রিট ফুড পাওয়া যায়?
গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেট, এবং ধর্মতলা এলাকায় প্রচুর স্ট্রিট ফুডের দোকান আছে।